ব্রেকিং:
বিএনপি নেতারা বউদের ভারতীয় শাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে না কেন? এপ্রিলে বাংলাদেশে আসছেন কাতারের আমির সিলিন্ডার ফেটে অটোরিকশায় আগুন, ভেতরেই অঙ্গার চালক ভুটানের রাজা ঢাকায় আসছেন আজ, সই হবে তিন এমওইউ মেঘনায় ট্রলারডুবি: দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধারকাজ শুরু দুপুরের মধ্যে তিন অঞ্চলে ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস যৌন হয়রানি রোধে কাজ করবে আওয়ামী লীগ জলবায়ু সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব: রাষ্ট্রপতি ইসরায়েলকে অস্ত্র না দেওয়ার ঘোষণা কানাডার ‘ইফতার পার্টিতে আল্লাহর নাম না নিয়ে আওয়ামী লীগের গিবত গায়’ গাজায় হামাসের শীর্ষ কমান্ডার নিহত রাফাহতে ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারে বাইডেনের আপত্তি নির্বাচনে জয়লাভের পর পরমাণু যুদ্ধ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিলেন পুতিন কুমিল্লায় বিজয় এক্সপ্রেসের ৯ বগি লাইনচ্যুত বাংলাদেশকে ২০ টন খেজুর উপহার দিল সৌদি আরব মায়ের আহাজারি ‘মেয়েটাকে ওরা সবদিক থেকে টর্চারে রাখছিল’ এই প্রথম ত্রাণবাহী জাহাজ ভিড়ল গাজার উপকূলে জিম্মি জাহাজের ৪ জলদস্যুর ছবি প্রকাশ্যে নাইজেরিয়ায় রমজানে রোজা না রাখা মুসলমানদের গ্রেফতার করছে পুলিশ বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা
  • শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

গাঁজার উৎপাদনে সেরা নওগাঁ, এখনো মজুত আছে ২২৬ মণ গাঁজা

কুমিল্লার ধ্বনি

প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২২  

নওগাঁ শহরের প্রায় সব উন্নয়নের মূলে রয়েছে গাঁজা সোসাইটির অবদান। বলা যায়, গাঁজাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নওগাঁ শহর। মসজিদ, মন্দির ও চিকিৎসায় অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে গাঁজা সোসাইটির সম্পদ। শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ের আশপাশে রয়েছে গাঁজা সোসাইটির (গাঁজা উৎপাদন পুর্নবাসন সমবায় সমিতি) প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

এক সময় গাঁজা উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে নওগাঁর বেশ সুনাম ছিল। বিচিত্র এই কৃষিজাত পণ্যের যেমন উন্নতি হয়েছে, তেমনি অবনতির ইতিহাসও কম নয়। গাঁজার উৎপাদনকে কেন্দ্র করে শহরে গাঁজার চারটি গুদামঘর তৈরি করা হয়। যেখানে গাঁজা গোলা মোড় নামে পরিচিতি পেয়েছে। গড়ে উঠেছে গাঁজা সমবায় সমিতি। ৩৫ বছর পূর্বে গাঁজা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তবে গাঁজা উৎপাদনকারীদের সেই সোনালি সময় এখন অতীত। অবৈধ দখল ও মামলায় জর্জরিত শত বছরের প্রাচীন উৎপাদনকারীদের এই বৃহত্তম সমবায় সমিতি।

শহরের মুক্তির মোড়ে গাঁজা সোসাইটির অফিস এখন দেখভাল করেন অফিস সহকারী আনিসুর রহমান। তার তথ্যানুসারে, সমিতির সম্পত্তির মধ্যে আছে ২৮টি ভবন, একটি হিমাগার, চারটি গোডাউন, একটি সরাইখানা, একটি মিটিং গ্রাউন্ড, তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১১টি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, একটি মন্দির, সাতটি বড় পুকুর ও একটি লেক। এসব সম্পদ নওগাঁ সদরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শত বছর ধরে নওগাঁর উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে গাঁজা সোসাইটির এসব সম্পদ। 

 

ছবি: ডেইলি বাংলাদেশ

গাঁজা উৎপাদন বিষয়ে খান সাহেব মোহাম্মদ আফজল এর লেখা ‘নওগাঁর মহকুমার ইতিহাস’ বই (সর্বশেষ প্রকাশ মে ২০০৭ সাল) থেকে জানা যায়, গাঁজা পাক-ভারতের প্রাচীন কৃষিজাত দ্রব্য। গাঁজার গাছ থেকে তিন রকম মাদকদ্রব্য যথা-চরশ, গাঁজা ও ভাঙ্গ পাওয়া যায়। গাঁজা তৈরির সময় কৃষকদের মনে আনন্দ ধরে না। গাঁজা মাড়াইয়ের সময় পা দিয়ে খোঁচানোর তালে তালে নাচের ভঙ্গিতে গান গাইতো।

গাঁজার মতো কৃষিজাত পণ্য পৃথিবীতে বেশি নেই। একমণ গাঁজা ৪০০ টাকারও বেশি মূল্যে বিক্রি হয়েছে। নওগাঁর উন্নয়নের মূলে রয়েছে গাঁজা। তবে কোথা থেকে কতদিন আগে নওগাঁ মহকুমার প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয় তার কোনো সঠিক ইতিহাস নেই।

জনশ্রুতি আছে- যশোর থেকে গাঁজার বীজ নিয়ে এসে নওগাঁ ও পাঁচুপুর থানায় (বর্তমানে আত্রাই ও রানীনগর পুলিশ স্টেশন) প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। আবহাওয়া ও জমি চাষে অনুকূল না হওয়ায় পাঁচুপুর থানায় গাঁজা চাষের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।

পূর্বে চাষিরা গাঁজা তৈরি করে নিজেরাই বিক্রি করতেন। তবে কী পরিমাণ জমিতে গাঁজার চাষ হতো তার সঠিক কোনো হিসাব বা তথ্য ছিল না। ১৮৭৬ সালে লাইসেন্স প্রথা চালু। এর আওতায় নির্দিষ্ট জমি ছাড়া ভিন্ন অন্য কোনো জমিতে গাঁজা করতে পারবে না। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে গাঁজা চাষের জন্য চারা তৈরি করে ১ ফুট উঁচু আইলে প্রায় ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি দূরে দূরে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা হতো। ফেব্রুয়ারি মাসে গাঁজা পরিপক্ব হয়। এরপর গাঁজা জটাগুলো সশস্ত্র পুলিশ পাহাড়ায় নওগাঁয় গাঁজা-গোলায় পাঠানো হতো।

বর্তমানে নওগাঁয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কার্যালয়ের মধ্যে গাঁজার চারটি গুদাম রয়েছে। এ কারণে এই এলাকা এখনো গাঁজাগোলা মোড় নামে পরিচিত। চারটি গুদামে এখনো ২২৬ মণ গাঁজা সংরক্ষণ করা আছে। গুদামগুলো এখন সিলগালা করা। জমির মালিকানা এখন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের।

১৯২১ সালে নওগাঁ গাঁজা কালটিভেটার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি স্থাপিত হয়। ওই সময় বাণিজ্যিকভাবে গাঁজা চাষের প্রচলন ছিল। সরকারি পৃষ্টপোষকতাও দেওয়া হতো। সাত হাজারের বেশি চাষি মিলে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে গাঁজা চাষ করতেন। নওগাঁর গাঁজা চাষিদের পুর্নবাসনের লক্ষে ১৯১৭ সালে গড়ে তোলা হয় নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পুর্নবাসন সমবায় সমিতি লিমিটেড। এ সমিতির সদস্য সংখ্যা ৬ হাজার ৬০০ জন।

 

ছবি: ডেইলি বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকদ্রব্যবিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই সমবায় সমিতির সদস্যদের পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবে চরম বিপাকে পড়েন। পরে তারা ধান, সরিষা, সবজি চাষাবাদ শুরু করেন।

১৯১৮ সাল থেকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার মণ গাঁজা উৎপাদন করা হতো। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হতো প্রায় ৬৬ লাখ টাকা।

শহরের মুক্তির মোড়ে গাঁজা সমিতির প্রধান অফিস ভবন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আদলে তৈরি। নেপাল থেকে শালকাঠ এনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তাছাড়া এক্সাইজ সুপারিনটেনডেন্টের জন্য দোতলা বাসভবন ও ডেপুটি চেয়ারম্যানের জন্য দোতলা ভবন ব্রিটিশ আমলে নওগাঁর অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়ায়।

ইকড়তাড়া গ্রামের সাবেক গাঁজা চাষি বয়োজ্যেষ্ঠ বাবু বলেন, দেড় বিঘা জমিতে গাঁজা চাষ করেছিলাম। গাঁজা রোপণের জন্য জমি চাষাবাদ করে প্রস্তুত করা হতো। এরপর বীজ বপন করা হয়। গাছ বড় হলে সুলি (আলুর জমির মতো) করে দিতে হয়। জমি পাহারা দেওয়ার জন্য সরকারি লোক রাখা হতো। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও পাহারা দিতাম।

বরুনকান্দি এলাকার এক সময়ের গাঁজা চাষি বয়োজ্যেষ্ঠ লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, সরকার হঠাৎ করেই গাঁজা চাষ বন্ধ ঘোষণা করে। এতে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। জমিতে কী করবো না করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরে ওইসব জমিতে শাক-সবজি, আলু, সরিষা, ধান ও পাটসহ বিভিন্ন চাষাবাদ করা শুরু করলাম।

বক্তারপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের বাসিন্দা গাঁজা সোসাইটি সমিতির সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বলেন, আমার যে যার মতো শেয়ার কিনে গাঁজা চাষ করতাম। কেউ ৫ কাঠা আবার কেউ ১০ কাঠা জমিতে চাষ করতো।
 
সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়নে র্কীত্তিপুর, মুরাদপুর ও গোবিন্দপুর সার্কেলে সরকারিভাবে গাঁজা চাষ হতো। গাঁজা চাষ করার পর সার্কেলে গিয়ে জমা দিতে হতো। সেইসব সোনালি অতীত। বর্তমানে গাঁজা সোসাইটির বেহাল অবস্থা। যেসব সম্পদ রয়েছে যে যেভাবে পেরেছে দখল করেছে। 

 

ছবি: ডেইলি বাংলাদেশ

গাঁজা সোসাইটি সমিতির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সে সময় পরিবারে কয়েক সদস্যের নামে লাইন্সেস নিয়ে প্রায় ৫ বিঘা জমিতে গাঁজা চাষ করা হতো। গাঁজা সোসাইটির যেসব সম্পদ রয়েছে সমিতির সদস্যরা ভোগদখল করার কথা। কিন্তু সেসব সম্পদ বাইরের লোকজন দখল করে রেখেছে। নামমাত্র টাকায় কোয়ার্টারগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

হিমাগারের ম্যানেজার আমিনুর রহমান বলেন, গাঁজা সোসাইটির যত সম্পদ রয়েছে তার মধ্যে ভালো একটা আয়ের উৎস ছিল এ হিমাগার। গত দুই বছর থেকে হিমাগারটি বন্ধ রয়েছে। ইজারা দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এরমধ্যে করোনাভাইরাস শুরু হয়। ইজারাদাররা ইজারা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও পরে নেয়নি। তবে আগামী ২০২৩ সালে ইজারা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

গাঁজা সোসাইটি কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান (২০০৫-২০০৬) নাজমুল হক জুয়েল বলেন, এক সময় কমিটির দায়িত্বে থাকলেও পদত্যাগ (রিজাইন) করে চলে আসি। পরে আবার আমাদের কমিটি থেকে বাতিল করা হয়। এরপর মামলা করে আমরা শেয়ার হোল্ডার ফিরে পাই। ২০০৭ সালের পর থেকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে।

নওগাঁ গাঁজা সোসাইটির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, গাঁজা সোসাইটির সম্পদ বেদখল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং আগে বেদখল হওয়া সম্পদ উদ্ধারে আমরা কাজ করছি।

তিনি আরো বলেন, হিমাগারটি সংস্কারের জন্য একটি টেকনিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। যেখানে সংস্কারে কী পরিমাণ ব্যয় হবে তা জানা যাবে। তারা প্রতিবেদন দিলে হিমাগারটি চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।