ব্রেকিং:
ছেলেকে ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি এমপির মন্ত্রী-এমপিরাই আওয়ামী লীগের নির্দেশ মানছে না ছাত্রলীগ নেতার আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল মার্চে কুমিল্লায় ৭১ অগ্নিকাণ্ড খুন ৭; সড়কে ঝরেছে ২০ প্রাণ মোহনপুরে নৌ-পুলিশের অভিযানে ১৩ জেলে আটক ১০০ পিস ইয়াবাসহ আটক ২ পূজা নিয়ে এমপি বাহারের বক্তব্য ব্যক্তিগত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেঘনায় মিলল নিখোঁজ জেলের মরদেহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেডক্রিসেন্টের অ্যাডহক কমিটি গঠন ইঁদুরের শত্রু, কৃষকের বন্ধু জাকির হোসেন বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে একই পরিবারের তিনজন নিহত, আহত ৩০ কুমিল্লায় ১৭ কোটি টাকার মাদক ধ্বংস নোয়াখালীতে রোহিঙ্গার পেটে মিলল ইয়াবা, গ্রেফতার ৪ দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাকাতের গুলিতে প্রাণ গেল ছাগলনাইয়ার দিদারের সুবিধা বঞ্চিত ১৬৫ শিক্ষার্থী পেলো ৮ লাখ টাকা অনুদান দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিকশায় ধাক্কা দিয়ে বাস খালে, নিহত ৩ শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে : কাদের সিদ্দিকী কুমিল্লা জেলা ছাত্র জমিয়তের সদস্য সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত নাঙ্গলকোটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে অনার্স শিক্ষার্থীর মৃত্যু দাউদকান্দিতে বাস চাপায় একই পরিবারের ৩ জন নিহত
  • শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বীরাঙ্গনা ফাতেমার কান্না

কুমিল্লার ধ্বনি

প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০২২  

কুমিল্লার লাকসামের পাইকপাড়া এলাকার মৃত আরব আলীর স্ত্রী বীরাঙ্গনা ফাতেমা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘গণ্ডগোলের বছর পাকিস্তানিরা নির্যাতন করেছে। মনে করছি আর মনে হয় বাঁচবো না। কিন্তু এখনো আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখছেন।’ 

তিনি বলেন, ‘কুমিল্লার ডিসি যে জায়গা আমাদের দিয়েছেন এটা নাকি অন্য মানুষের জায়গায়। এ ব্যাপারে আমার মেয়ে ও মেয়ের জামাই ইউএনও’র কাছে গিয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’ 

বীরাঙ্গনা ফাতেমা বেগমের বড় মেয়ে খুরশিদা বেগম বলেন, ‘আমার কোনো ভাই নেই, বাবাও বেঁচে নেই। আমরা তিন বোন। আমার স্বামী রিকশা চালায়। মা খুব অসুস্থ থাকে প্রায়ই। অনেক ওষুধ কিনতে হয়। রিকশা চালিয়ে সংসারে খরচ করে আমার গরিব স্বামী ভালো করে মার খেদমত করতে পারে না। আমার মা তিন বেলা খাইতে পারে না। ডিসি কল্লোল থাকতে আমাদের খাস জমি দিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। আমরা দখল করতে গেলে অন্য মানুষ বাঁধা দেয়। 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের স্মৃতি মনে করে ফাতেমা বেগম জানালেন, তার বাবার নাম সালেহ আহমেদ। মা শামসুন নাহার। বাবা-মা’র ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তান। নোয়াখালী জেলার খিলাবাজারে তাদের বাড়ি। লাকসাম পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের পাইকপাড়া গ্রামের আরব আলীর সঙ্গে তার ১৯৭০ সালে বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ফাতেমা বেগম ৭ মাসের অন্ত:সত্ত্বা। বাবা-মা মেয়ের প্রথম সন্তান নিজ বাড়িতে প্রসব করাবার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে যান। কিন্তু সে সময়ে যখন দেখলেন নোয়াখালীর খিলাবাজারের আশেপাশে পাক বাহিনীর আনাগোনা বেশি।

স্থানীয় সুন্দরী মেয়ে দেখলেই পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন ভয় পেয়ে যান ফাতেমা বেগমের বাবা-মা। তাই স্বামীর বাড়ি নিরাপদ হবে ভেবে ‘নাইর’ নেবার ৭ দিনের মধ্যেই তাকে পুনরায় স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। 

ফাতেমা বেগম বলেন, সম্ভবত জুলাই কি আগস্ট মাস। বর্ষাকাল। একদিন দুপুর বেলা পাক বাহিনী পুরো পাইকপাড়া ঘেরাও করে মুক্তিবাহিনীদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গোয়াল থেকে গরু নিয়ে যাচ্ছে। যুবতী মেয়েদের ধরে ধরে নির্যাতন করছে। যুবক দেখলেই মারধর করছে। এ খবর পুরো গ্রাম ছড়িয়ে পড়ল। শ্বাশুড়ি এসে বলল, ‘বউ ঘরের বাইরে বাহির হবা না। দরজা আটকে বসে থাকবে।’ 

আমার স্বামী তখন জমিতে কাজ করছে। জোহরের আজান দিবে দিবে এমন সময় আমি যে ঘরে থাকতাম সে ঘরের দরজায় জোরে ধাক্কা হলো। ঘরটি ছিল মুলি বাঁশ দিয়ে তৈরি। দরজাও তেমন। আমি ভয়ে কাঁপছি আর আল্লাহকে ডাকছি। ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। শ্বাশুড়িও যেন কোন ঘরে লুকিয়ে আছে। বেড়ার দরজাটি ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। আমি একটি চৌকির নিচে লুকিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে চুলের মুঠি ধরে বের করল। 

আল্লাহ রসুলের নামে কসম দিয়ে বললাম, আমি ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আমার কান্না, অনুরোধ তারা শুনলো না। বিজাতীয় ভাষায় তারা কিছু আলোচনা করলো। আমি কিছুই বুঝলাম না। তাদের সঙ্গে বাঙালি একজন ছিল। তাকে বের হয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতে বলল। তারপর এই তিন নরপিশাচ আমাকে পালাক্রমে নির্যাতন করল। বাড়ির আশেপাশের পরিবেশ একেবারে নীরব। বুঝলাম সবাই ভয়ে পালিয়েছে। কেউ নেই। আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন ফাতেমা বেগম। 

তিনি বলেন, বর্ষা ছিল বলে তারা নৌকা দিয়ে এসেছিল। চর্তুদিকে পানি আর পানি। পাক আর্মি নৌকায় উঠে চলে যাচ্ছে দেখে আমার স্বামী বাড়ির দিকে দৌঁড়ে আসতে থাকে। কিন্তু পাক আর্মি তাকে দেখে ফেলে এবং ধরার জন্য আমাদের বাড়ির দিকে নৌকা ঘুরায়। আমার স্বামী ব্যাপার বুঝে উল্টো দিকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। আমি তখন ঘরের মেঝেতে পড়েছিলাম। এমন সময় কে যেন বাহির থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, বউ পালাও, আবার আসছে। কথাটা আমার কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর কোনো কিছু না ভেবে দৌঁড় দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিলাম। একেতো আমার পেটে ৭ মাসের সন্তান তার ওপর তিন নরপশুর নির্যাতনে আমি এমনই দুর্বল ছিলাম যে, সাঁতার দিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে এই বুঝি পানিতে ডুবে মরে যাবো। কোন রকমে ওপার গিয়ে শুধু বললাম, কে আছেন আমাকে পানি থেকে তোলেন। এরপর আর কিছু বলতে পারব না। যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন দেখি অনেক রাত। আমি আমার বাবার বাড়িতে। এরপর আমাকে খুঁজতে আরো কয়েক রাত পাক বাহিনী আমাদের ঘরে হানা দিয়েছিল কিন্তু আমাকে না পেয়ে আমার বৃদ্ধ শ্বাশুড়িকে বন্দুকের বাট দিয়ে বেধড়ক মেরেছিল। 

ফাতেমা বেগম তার পেটের সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই মারা গিয়েছিল বলে জানালেন। পরবর্তীতে তার ১০ মেয়ে ও ২ ছেলে জন্ম নিয়েছিল। বর্তমানে ৩ মেয়ে বেঁচে আছে আর সবাই অনেক আগেই মারা গেছে। ছোট মেয়েটি এখনো অবিবাহিত। তাদের একটি ভাঙা বেড়ার ঘর রয়েছে। বৃষ্টির পানি যে ভেতরে পড়ে এটা বড় কথা না। বড় কথা হচেছ এটা এমনই জীর্ণশীর্ণ যে, অবিবাহিত মেয়েকে নিয়ে মাথা গুঁজে থাকার উপযুক্তও নয় এটি। বাড়ি বাড়ি কাজ করেন ফাতেমা বেগম। শরীর খারাপ থাকলে কাজ করতে পারেন না। ঐ দিন না খেয়ে থাকতে হয়। বড় মেয়ে খুরশিদা একই বাড়িতে থাকেন। স্বামী রিকশা চালান। নিজেদের খাবার জোটে না ঠিকমতো।

বড় মেয়ে খুরশিদা বেগম দুঃখ করে বললেন, ‘সরকারি সাহায্য মা পাবে এমন আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার এতো বছর পর এবার লাকসাম উপজেলা থেকে লোক এসে বলল, ‘ডিসি আপনার মাকে জমি দেবে, সম্মান দেবে, তাই কুমিল্লা যেতে হবে। মাকে নিয়ে কুমিল্লা গেলাম। অনেক বড় বড় মানুষ দেখলাম। সুন্দর সুন্দর কথা শুনলাম। সেই অনুষ্ঠানে মাকে জমি দিল। অবশেষে সে জমি বুঝে পেতে ৬ মাস সময় লাগল। লাকসাম উপজেলার দক্ষিণ রামপুর মৌজায় ১ নম্বর খতিয়ানের ৩৬ দাগের হালে ৭১ এ ৩ শতক জায়গা আমার মাকে দিয়েছে। আবাদ অযোগ্য এই জায়গাটিতে উপজেলার লোক এসে কিছু দিন আগে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়ে গেছে। এতো দিন স্থানীয় প্রভাশালীদের ভয়ে দখল নিতে পারছিলাম না। জানি না ভবিষ্যতে তারা আবার এ নিয়ে আর কিছু করে কি না। 

বীরাঙ্গনা ফাতেমা বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, পাক বাহিনীর নির্যাতনের পর কত অপমান, অপদস্ত সহ্য করেছি, কত খোটা শুনেছি তার কোনো হিসেব নেই। সেই বিভীষীকাময় নির্যাতনের কথা এখনো ভুলতে পারি না। শেষ জীবনে যেন শান্তিতে নিজের ঘরে ঘুমাতে পারি, তিন বেলা না হোক দুই বেলা যাতে ভাত খেতে পারি আর আমার মেয়েটিকে যাতে বিয়ে দিতে পারি এ ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আকুতি। সরকার যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ ছাড়া আমার আর চাওয়ার কিছু নেই।