ব্রেকিং:
বিএনপি নেতারা বউদের ভারতীয় শাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে না কেন? এপ্রিলে বাংলাদেশে আসছেন কাতারের আমির সিলিন্ডার ফেটে অটোরিকশায় আগুন, ভেতরেই অঙ্গার চালক ভুটানের রাজা ঢাকায় আসছেন আজ, সই হবে তিন এমওইউ মেঘনায় ট্রলারডুবি: দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধারকাজ শুরু দুপুরের মধ্যে তিন অঞ্চলে ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস যৌন হয়রানি রোধে কাজ করবে আওয়ামী লীগ জলবায়ু সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব: রাষ্ট্রপতি ইসরায়েলকে অস্ত্র না দেওয়ার ঘোষণা কানাডার ‘ইফতার পার্টিতে আল্লাহর নাম না নিয়ে আওয়ামী লীগের গিবত গায়’ গাজায় হামাসের শীর্ষ কমান্ডার নিহত রাফাহতে ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারে বাইডেনের আপত্তি নির্বাচনে জয়লাভের পর পরমাণু যুদ্ধ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিলেন পুতিন কুমিল্লায় বিজয় এক্সপ্রেসের ৯ বগি লাইনচ্যুত বাংলাদেশকে ২০ টন খেজুর উপহার দিল সৌদি আরব মায়ের আহাজারি ‘মেয়েটাকে ওরা সবদিক থেকে টর্চারে রাখছিল’ এই প্রথম ত্রাণবাহী জাহাজ ভিড়ল গাজার উপকূলে জিম্মি জাহাজের ৪ জলদস্যুর ছবি প্রকাশ্যে নাইজেরিয়ায় রমজানে রোজা না রাখা মুসলমানদের গ্রেফতার করছে পুলিশ বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা
  • শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সঙ্গী সোভিয়েত ইউনিয়ন

কুমিল্লার ধ্বনি

প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯  

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারত প্রত্যক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করলেও পরোক্ষে সর্বাত্মক ভূমিকা রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এ রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জোরালো পদক্ষেপ নেয়। এ রাষ্ট্রের অনমনীয়তার কারণেই পাকিস্তানের পক্ষে একাত্তরের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েও তা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার পাশাপাশি স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণেও দৃষ্টান্তস্থানীয় ভূমিকা রেখেছে এ দেশটি। নব্বইয়ের দশকে এ রাষ্ট্র ভেঙে ১৫টি নতুন দেশ হয়েছে।

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ভারত। এর পরপরই সোভিয়েত ইউনিয়ন গণহত্যা বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানায়। তাদের মূল্যায়ন ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শক্তি এশিয়ায় খর্ব হবে। তাই তারা ভারতকে আশ্বাস দেয়, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। এ প্রেক্ষাপটে একাত্তরের ২ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোরনি একটি চিঠি লেখেন। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের খবরে উদ্বেগ, শক্তি ব্যবহার না করে রাজনৈতিক পথেই সংকট মোকাবেলার পরামর্শ এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার কথা বলা হয়েছিল। এভাবে তখন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন- মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উন্মুক্ত হয়েছিল পরাশক্তিগুলোর স্নায়ুযুদ্ধের নতুন এক ফ্রন্ট।

১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সরকারি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে। সেখানে ১৩ থেকে ১৬ মে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। অপর দুই সদস্য হলেন ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দেওয়ান মাহবুব আলী ও বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা.সারওয়ার আলী।

মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা প্রসঙ্গে সারওয়ার আলী বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে সমর্থন দেওয়ায় ভারত সরকারের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতার নিশ্চয়তা ছাড়া বড় ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব ছিল না। সম্মেলনের নেপথ্যে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে আমরা সোভিয়েত সমর্থনের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলাম। এর ধারাবাহিকতায় পরে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল।' 

তিনি বলেন, 'সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিষয়ে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে তিনবার ভেটো না দিলে ইতিহাসের গতিস্রোত অন্যরকম হতো। মার্কিন সপ্তম নৌবহরকেও সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশান ৬ নম্বর ফ্লিট ভারত মহাসাগর পর্যন্ত তাড়া করেছিল। এতে কোনো সংশয় নেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃঢ় অবস্থান ছাড়া ৯ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ত।'

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোরনির চিঠি পাঠানোর পরপরই ৬ এপ্রিল মার্কিন নীতি নিয়ে ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট থেকে আর্চার কে ব্লাড ও তার অধস্তন ২০ সহকর্মীর পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়, যা হোয়াইট হাউসকে বিব্রত করে। ব্লাড লিখেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে গণতন্ত্র সুরক্ষা ও রক্তপাত বন্ধের আবেদন করেছে, সেখানে 'পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়' অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র নৈতিক প্রতিবাদ জানাতেও ব্যর্থ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এরপরও পাকিস্তানকে অস্ত্রসহ যাবতীয় সাহায্য-সহযোগিতা দিতে থাকে। তারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। যাতে কোনো দেশ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা ও সমর্থন না দেয়। ইতিমধ্যে জাতিসংঘেও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক সমকালকে বলেন,  'যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রশাসন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলে ভারত উপলব্ধি করে, বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তখনকার প্রভাবশালী দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক লড়াই করা দুরূহ। এই ধারণা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং এই পরাশক্তিকে নিজেদের দিকে টানতে সক্ষম হন। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেপথ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিতে থাকে এবং সেপ্টেম্বরে সরাসরি সমর্থন দেয়।'

 তিনি বলেন, সোভিয়েত রাশিয়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় পরাশক্তি হওয়ায় তাদের সহযোগিতা ও সমর্থন তখন বাংলাদেশ সরকার এবং যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়।

একাত্তরের ৯ আগস্ট দিল্লিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি অনুসারে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কোনো কারণে যুদ্ধ দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলে সোভিয়েতও ভারতের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি ও বাঙালি গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তান সরকারের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ সময় দুই দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অস্ত্র এবং সামরিক সহায়তাও দেওয়া হয়। পরে ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে মিত্রবাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করে ভারত। মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে যুদ্ধে যখন বাঙালির বিজয় আসন্ন, তখন ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় পাকিস্তানের পক্ষে তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করতে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে সপ্তম নৌবহরও পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে আগস্ট মাসের দিল্লি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পক্ষে শক্তি বাড়ানোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নও পাল্টা ৬ নম্বর রাশান ফ্লিট পাঠিয়ে দেয় বঙ্গোপসাগর অভিমুখে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে করা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও ভেটো দেয় রাশিয়া। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এভাবে একাত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে যুদ্ধে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখে।

এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যে পাকিস্তানের হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারির পদ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কর্মরত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ভেটো না দিলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হতো। তা হলে হয়ত আমাদেরও ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ করতে হতো। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভূমিকা রেখেছে, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে।'

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও রাশান সৈন্যরা বাঙালিদের জন্য জীবন দিয়েছিল। কারণ, চট্টগ্রাম বন্দরে হাজার হাজার মাইন পুঁতে রেখেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ওই মাইন অপসারণ করতে গিয়ে কয়েকজন রাশান যোদ্ধাকে জীবনও দিতে হয়। তাদের এই অবদান কখনও ম্লান হওয়ার নয়।'  স্বাধীনতার পর জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার অবদানও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন মন্ত্রী।