ব্রেকিং:
৪ মে থেকে বাড়ছে ট্রেনের ভাড়া সেকান্দর চেয়ারম্যানসহ ১৪ জনের যাবজ্জীবন মোহনপুরে নৌ-পুলিশের অভিযানে ১৩ জেলে আটক ১০০ পিস ইয়াবাসহ আটক ২ পূজা নিয়ে এমপি বাহারের বক্তব্য ব্যক্তিগত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেঘনায় মিলল নিখোঁজ জেলের মরদেহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেডক্রিসেন্টের অ্যাডহক কমিটি গঠন ইঁদুরের শত্রু, কৃষকের বন্ধু জাকির হোসেন বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে একই পরিবারের তিনজন নিহত, আহত ৩০ কুমিল্লায় ১৭ কোটি টাকার মাদক ধ্বংস নোয়াখালীতে রোহিঙ্গার পেটে মিলল ইয়াবা, গ্রেফতার ৪ দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাকাতের গুলিতে প্রাণ গেল ছাগলনাইয়ার দিদারের সুবিধা বঞ্চিত ১৬৫ শিক্ষার্থী পেলো ৮ লাখ টাকা অনুদান দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিকশায় ধাক্কা দিয়ে বাস খালে, নিহত ৩ শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে : কাদের সিদ্দিকী কুমিল্লা জেলা ছাত্র জমিয়তের সদস্য সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত নাঙ্গলকোটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে অনার্স শিক্ষার্থীর মৃত্যু দাউদকান্দিতে বাস চাপায় একই পরিবারের ৩ জন নিহত সিদ্দিকী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি না থাকলে সেটা কলঙ্কজনক হবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত বিজিবি
  • বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বীকৃতি পেলেও এখনো মেলেনি ভাতা

কুমিল্লার ধ্বনি

প্রকাশিত: ৬ মার্চ ২০২২  

শনিবার বিকেলে ফোন করে পরিচয় দিতেই কেঁদে দিলেন বীরাঙ্গনা মোসা. মমতাজ বেগম ওরফে জাহানারা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই বীর নারী জানালেন, ‘বাবা আপনি লেখনে আমি সরকার থেইক্যা বীরাঙ্গনা অইতে বীর নারী অইছি। কিন্তু এহন সরকার যে ভাতা দেয় না। গতবার ঢাকা গেছিলাম। কতা কইল কিন্তু ভাতা দিল না। দিন মজুর ফুতের (ছেলে) কামাই দিয়া তিন বেলা ঠিক ভাবে খাইতে অই ফারি না আবার ঔষধ খামু ক্যামনে ? সরকারকে একটু কন না বাবা, তারাতারি কইরা যে আমারে ভাতাডা দেয়’- এভাবেই এক নিঃশ্বাসে শুদ্ধ অশুদ্ধ মিলিয়ে কথাগুলো বললেন , বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম। 

মমতাজ বেগমের ছেলে দিন মজুর মো. হোসেন বলেন, স্যার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রালয়ের ৬১তম সভার সিদ্ধান্তক্রমে ২০২১ সালের ২৭ মার্চ মাকে নিয়ে ঢাকায় যাই। ঐ সময় আমরা কথা বলে আসি। স্যারেরা বলেছে যোগাযোগ করবে। কিন্তু এক বছর হয়ে গেল। এখনো আমার মা কোনো ভাতা পায়নি। প্রতিদিনই মার অনেক ওষুধ লাগে। মা মরে গেলে সরকারের ভাতা দিয়ে আমাদের কি হবে। আপনি পত্রিকায় লিখে আর বই বের করে মার খবর সারা দেশকে জানিয়েছিলেন। যার কারণে বীর নারী স্বীকৃতি মা পেয়েছে। কিন্তু ভাতা তো আজো পাইনি। 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের যেসব মা-বোনদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন চালিয়েছিলেন তাদেরই একজন হলেন মমতাজ বেগম। বিয়ের মেহেদি তখনো তার হাত থেকে শুকায়নি। স্বামী, শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির স্বজনদের নিয়ে নববধূ যখন রঙিন স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনি তার জীবনে নেমে আসে অমাবশ্যার কালো আঁধার। যে আঁধারে আঁধারে কেটে গেছে তার জীবনের ৬০টি বসন্ত। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন থেকে তিনি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেন বীরাঙ্গনা হিসেবে। আর এর তিন বছর পেলেন বীর নারীর সম্মান। এ বীরাঙ্গনা হলেন কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামের মনু মিয়ার স্ত্রী মমতাজ বেগম। 

মমতাজ বেগম কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মার ৭ মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দেখতে শুনতে ভালো। তাই ১৪/১৫ বছরেই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেন একই জেলার আদর্শ সদর উপজেলার কালিরবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম আনন্দপুর গ্রামের মনু মিয়ার সঙ্গে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে মমতাজ-মনু মিয়ার দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু না হলেও দেশের অবস্থা ভালো ছিল না বলে মমতাজ বেগম জানান। অজোপাড়াগাঁয়ের টু-থ্রি পড়া মেয়ে ঢেড় বুঝতে পারতেন ঢাকায় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তখন সারা দেশেই থমথম অবস্থা বিরাজ করছিল। বিয়ের পর দিনই স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন মমতাজ বেগম। 

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের বৈশাখ মাসের কোনো এক সকাল, তখন ৮টা কি ৯ টা হবে। শাশুড়ি, স্বামী ও ভাশুরকে নাস্তা দিয়েছেন। সবার খাওয়া শেষ। এখন তিনি নাস্তা করবেন। ঠিক এই সময় গ্রামে খবর এলো পাক বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করেছে। গ্রামের গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। যুবক ছেলেদের মারধর করছে আর যুবতি মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা শোনার পর আমার শাশুড়ি বললেন, বউ পালাও- একথা বলে তিনি নিজেই দিলেন দৌঁড়। এই বাড়িতে আমি বউ হয়ে আসছি মাত্র ৩ মাস হতে চলল। ভালোভাবে সবার বাড়ি ঘর চিনি না। কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। 

নাস্তা আর খাওয়া হলো না। দিলাম হরুজী বাড়ির দিকে দৌঁড়। যেই মাত্র হরুজী বাড়ির উঠানে এলাম ওমা! এসেই দেখি ৭/৮ জন পাক আর্মি আমার সামনে দণ্ডায়মান। দৌঁড়ের কারণে আমি হাঁপাচ্ছিলাম। অমনি একজন আমার চুলের খোঁপা ধরে বিজাতীয় ভাষায় যেন কি বলল, বুঝলাম না। তারা একটি ঘরে নিয়ে আমাকে ব্যাপক নির্যাতন করল। বাপ ভাই ডেকেও তাদের হাত থেকে রেহাই পেলাম না। এক সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান যখন ফিরে এলো তখন দেখি চারদিকে অন্ধকার। চোখের পানি মুছতে মুছতে অজানা আশঙ্কা নিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি। ভাবছি হয়তো আজই আমার সংসার জীবন শেষ। স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্ত না। ঘরে ঢুকেই দেখি সবাই আমার জন্য অস্থির হয়ে আছে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে বিছানায় ঢলে পড়লাম। এমন সময় আমার ভাসুর ফজর আলী, স্বামী মনু মিয়া ও শাশুড়িসহ সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, যা ঘটেছে তার বিচার আল্লাহ করবেন। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। ভোর রাতে বরুড়ায় আমরা সবাই চলে যাব। এই গ্রামে আর না। 
মনু মিয়া তার স্ত্রী মমতাজ বেগমকে নিয়ে ভোর রাতেই বাবার ফুফুর বাড়ি বরুড়া উপজেলার কাশেড্ডা গ্রামে চলে গেল। যাতে পাছে লোকে মমতাজ বেগমকে কিছু বলতে না পারে। 

দেশ স্বাধীন হলো ১৬ ডিসেম্বর। মনু মিয়া তার স্ত্রী মমতাজ বেগমকে নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর সকালে নিজ বাড়ি আনন্দপুর ফিরলেন। মমতাজ বেগম লক্ষ্য করলেন, এতদিন যারা তাকে আদর করত, ডাক খোঁজ নিত, তারা এখন দূর থেকে তাকে আড় চোখে দেখে। কেউবা তাকে সান্ত্বনার নামে খোঁচা দিয়ে কথা বলে, তার চাপিয়ে রাখা কষ্ট উসকে দেয়। তবে সান্ত্বনা এই যে, স্বামীর ঘরের কেউ-ই তাকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দায়ী করেনি। বরং তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনাকে শাশুড়ি পাক সেনাদের প্রতি আল্লাহর গজব বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিবেচনা করতেন বলে জানালেন মমতাজ। 

মমতাজ বেগম আরো বলেন, ৭১ সালের এই দুঃখজনক ঘটনার কারণে কখনো বেশি মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াইনি। স্বজনদের নানা অনুষ্ঠানে যাইনি। যদি কখনো তারা এ প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করে। কত নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে যে গত ৪৪ বছর ধরে বেঁচে আছি তা কাউকে বুঝাতে পারব না। শুনেছি, এ রকম নির্যাতনের শিকার নারীদের সরকারের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে নানা সাহায্য সহযোগিতা করছে। কিন্ত গত ৪৪ বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। এবার জেলা প্রশাসন কুমিল্লায় অনুষ্ঠান করে আমার মতো আরো ১৪-১৫ জনকে সরকারি খাস জমি দিয়েছে। 

মমতাজ বেগম বলেন, ৪ মেয়ে ও তিন ছেলের সংসার আমার। স্বামীরও বয়স হয়েছে। কাজ করতে পারছেন না। ছেলেরাও নিয়মিত কাজ পায় না। আপনি দেখতে পাচ্ছেন এই ছোট দোচালা ঘরটিই আমার একমাত্র সম্বল। এই সমাজের কাছে, সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, দয়া করে আমাকে যে স্বীকৃতি দিয়েছেন সেই স্বীকৃতির মাসিক ভাতাটা এবার দিন। যেন,মৃত্যুর আগে শান্তিতে ঘুমাতে পারি। 

স্বামী মনু মিয়া বললেন, ভাই, পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার স্ত্রীকে নির্যাতন করায় যতটুকু কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি এই দেশের মানুষদের আচরণে, যারা সুযোগ পেলেই এই প্রসঙ্গটি এনে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলত। আমাকে অনেকে কটু কথা বলত। আমি কোনো দিন তা মনে নেইনি। শুধু বলেছি, আমার স্ত্রীর কোনো দোষ নেই। আমার স্ত্রী দেশের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এটাই আমার কাছে গর্বের বিষয়।