ব্রেকিং:
দেশে পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনো দিন হবে না এটা আমার শেষ বিসিএস ছিল, ৩-৪ মিনিটের জন্য স্বপ্ন ভেঙে গেল এক সপ্তাহে রেকর্ড সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি এসটিপি ছাড়া নতুন ভবনের অনুমোদন দেওয়া হবে না : গণপূর্তমন্ত্রী সাড়ে ৫৮ লাখ টাকার হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ জব্দ পুকুর থেকে মাদরাসা ছাত্রীর লাশ উদ্ধার বাংলাদেশি জিনাতের সোনা জয় দক্ষিণ আফ্রিকার বক্সিংয়ে নিয়মিত দ্বিগুন মাত্রার শব্দে দূষণের শিকার কুমিল্লা নগরী দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধ-র্ষ-ণে-র অভিযোগ দেশের যত অপরাধ তার সবই করে বিএনপি: প্রধানমন্ত্রী শিশু সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যা বিশেষ কায়দায় ৪০ কেজি গাঁজা পাচার দুদিনব্যাপী পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষক প্রশিক্ষণ ৪ মে থেকে বাড়ছে ট্রেনের ভাড়া সেকান্দর চেয়ারম্যানসহ ১৪ জনের যাবজ্জীবন মোহনপুরে নৌ-পুলিশের অভিযানে ১৩ জেলে আটক ১০০ পিস ইয়াবাসহ আটক ২ পূজা নিয়ে এমপি বাহারের বক্তব্য ব্যক্তিগত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেঘনায় মিলল নিখোঁজ জেলের মরদেহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেডক্রিসেন্টের অ্যাডহক কমিটি গঠন
  • শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পত্রিকা বিলি করে যেতে চান শুক্কুর আলী

কুমিল্লার ধ্বনি

প্রকাশিত: ২ এপ্রিল ২০২১  

২০ বছর ধরে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান কোনো কিছুই তাকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। ফজরের আজান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘর থেকে বের হয়ে যান। একটু দেরি করার ফুসরত নেই তার। কারণ, যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে পত্রিকার বান্ডেল যদি কেউ নিয়ে যায়। তাই পত্রিকার বান্ডেল ঘাটে আসার আগেই তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।

পত্রিকার বান্ডেল খুলে গুনে গুছিয়ে এবার তার দৌড়। পাঠকের বাসা বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ছোট বড় দোকানের অলিগলিতে তার অবিরাম ছুটে চলা। এ যেন এক নিখুঁত ডাক হকার। শরীরে বয়সের ছাপ পড়েছে সুস্পষ্ট। কিন্তু মনে ছাপ পড়েনি এতোটুকু। অসুখ হলেও কখনো থেমে থাকেননি তিনি। কাউকে দায়িত্বও দিতে চান না। কারণ, প্রতিদিন সকালে পত্রিকার ঘ্রাণ না শুনলে যে পেট ভরে না তার। 

গত বিশ বছর ধরে এই ঘ্রাণটিই নিয়ে এসেছেন তিনি। শরীর না চাইলে মন চাচ্ছে না পত্রিকার হকার পেশা ছাড়তে। কারণ, এই পত্রিকা বিলি করেই তিনি পেয়েছেন, অর্থ, যশ ও খ্যাতি। প্রবাসী ছেলে প্রতিনিয়ত পত্রিকার হকারি ছাড়তে বললেও রাজি নন তিনি। তার পরিষ্কার কথা, ‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পত্রিকা বিলি করে যেতে চাই।’

বলছিলাম পত্রিকা বিলিকারী শুক্কুর আলীর কথা। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার মনিপুর ইউপির ঘারমোড়া গ্রামের আবদুল মালেক ও হালিমা বেগমের ছেলে শুক্কুর আলী। বাবা মায়ের সাত ছেলের মধ্যে তিনি সবার বড়। দরিদ্র বাবার পক্ষে সম্ভব হয়নি তাকে পড়াশোনা করানো। ছোট বয়স থেকেই শুরু করেছেন বাবার সঙ্গে সংসারের ঘানি টানতে। করতেন দিনমজুরের কাজ। নব্বই দশকের শেষ দিকে শুরু করলেন রিকশা চালানো। 

২০০১ সালে একদিন হোমনায় তার রিকশায় চড়ে বসেন কুমিল্লার সংবাদপত্রের এজেন্ট নিউজ কর্নারের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী। রিকশা চালাতে শুক্কুর আলীর কষ্ট হয় দেখে মোহাম্মদ আলী তাকে প্রস্তাব দেন, পত্রিকার বিলিকারী হতে। মাত্র এক বেলা কাজ করলেই ভাল আয় করা সম্ভব। রাজি হয়ে গেলেন শুক্কুর আলী। এই যে তার নতুন পথ চলা শুরু। আর তাকে কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পত্রিকা বিলি করাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পেশা এবং নেশা হয়ে গেল। 

পত্রিকার বিলিটাকে তিনি ইবাদত হিসেবে মেনে নিল। এই পত্রিকা বিলি করেই তিনি পেলেন উজ্জ্বল সফলতা। নিজস্ব ভুবনে শুক্কুর আলী বেশ সফল মানুষ। পত্রিকা বিলির টাকা দিয়েই বড় ছেলেকে পাঠিয়েছেন কুয়েত। আর এক ছেলে ও এক মেয়েকে পড়াচ্ছেন। ছোট ছেলে জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। আর এক মাত্র মেয়ে এবার অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। মনের মতো করে সুন্দর একটি বাড়ি করেছেন। বাড়ির সামনে একটি ছোট বাগানও সাজিয়েছেন। বাড়িটি দালান না হলেও তার অবয়ব কারুকার্য বেশ নান্দনিক। তার এই সৌন্দর্যে ভরা টিনের ঘরের তৈরি সবুজ আচ্ছাদিত বাড়িটি দেখতে প্রায় নানা এলাকার মানুষ আসে।  

অর্থনৈতিকভাবে বেশ সচ্ছল হলেও পত্রিকা বিলি তিনি ছাড়বেন না। তা সাফ জানিয়ে দেন কুয়েত প্রবাসী বড় ছেলেকে। এক সময় অভাব অনটন ছিল বলে হকারি করেছেন। এখন ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে, পড়াশোনা করছেন, একজন বিদেশও আছেন। তারপরেও কেন পত্রিকা বিলি করছেন জানতে চাইলে শুক্কুর আলীর চোখ জলে ছল ছল করে উঠল। 

ভারাক্রান্ত ভাঙা মনে শুক্কুর আলী বলেন, নিউজ কর্নারের এজেন্ট মোহাম্মদ আলী ভাই আজ থেকে ২০ বছর আগে আমাকে রিকশাচালককে পত্রিকার হকার বানিয়েছেন। এই পত্রিকা বিলি করতে গিয়ে আমার সঙ্গে এমপি, মন্ত্রী, ইউএনও, ওসি, চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে ধনী গরিব সবার সঙ্গেই আমার এক ধরনের ভালোলাগা ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে গেছে। 

তিনি বলেন, অনেক হকাররা অনেক দেরিতে পত্রিকা দেয়। সময়ে সময়ে গ্যাপ দেয়। কিন্তু আল্লাহর রহমতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবার হাতে হাতে পত্রিকা পৌঁছে দিই আমি। কোনোদিন গ্যাপও দেইনি। যার কারণে সবাই আমাকে আদর করে ভালোবাসে। বিল নিয়ে গত বিশ বছরে কারো সঙ্গে আমার দুই কথাও হয়নি। পত্রিকা দিতে গেলে বড় বড় অফিসাররা আমাকে শুক্কুর আলী বলে ডাক দেয়, ভালো মন্দ জানতে চায় - এটা আমার কাছে খুব সম্মানের মনে হয়। 

তিনি আরো বলেন, আমি মূর্খ মানুষ। পত্রিকা বিলি না করলে এতো বড় বড় মানুষগুলো আমাকে চিনতো না, জানতো না। এলাকার যে কোনো প্রয়োজনে চেয়ারম্যান মেম্বারের কাছে গেলে আমার সমস্যা আগে সমাধান করে। বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছি, ছোট এক ছেলে  ও এক মেয়েকে হাই স্কুলে পড়াচ্ছি। মনের মতো করে একটি সুন্দর বাড়ি করেছি। বাড়ির সামনে ডিজাইন করে ফুল বাগান করেছি। অনেক বড় বড় মানুষ আমার বাড়ি দেখতে আসে। এটা যে আমার  কি আনন্দ তা কি করে বুঝাই। 

শুক্কুর আলী বলেন, মানুষের ভালোবাসা থেকে আর বড় কোনো জিনিস পৃথিবীতে নেই। পত্রিকার হকারি করে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। তাই পত্রিকার হকারি ছেড়ে দিলে এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবো। অপর দিকে প্রতিদিন ভোরে পত্রিকার যে ঘ্রাণটা পাই, এই ঘ্রাণ থেকেও বঞ্চিত হবো। 

কুয়েত প্রবাসী ছেলে বলে, ‘বাবা তুমি তো সারাজীবন কষ্ট করেছ এবার অবসরে যাও। কিন্তু আমি তাকে পরিষ্কার না করে দিয়েছি। বলেছি, আল্লাহ যেন আমাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পত্রিকা বিলি করতে সহযোগিতা করেন।’ 

 তিনি জানালেন, আজকে এই পর্যায়ে আসার পেছনে মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের অবদান অনেক বেশি। আগে আড়াইশ’র ওপর পত্রিকা বিলি করেছি। করোনার পর থেকে পত্রিকা বিলি কমে গেছে। এখন একশ’ থেকে দেড়শ’ পত্রিকা বিলি করি। স্বাভাবিকভাবেই আয় কমে গেছে। এখন পত্রিকা বিলি করি, ভালোবাসা আর ভালোলাগার কারণে টাকার জন্য নয়। 

নিউজ কর্নারের মালিক মোহাম্মদ আলী বলেন, শুক্কুর আলীকে ২০ বছর আগে রিকশাচালক থেকে হকার বানিয়েছি। তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে তিনি খুব সৎ। একটি পয়সাও হেরফের করে না, যা এই পেশায় বিরল। ব্যবহারও ভালো এবং অধিক পরিশ্রম করতে পারে। যার  কারণে হোমনার যে এলাকায় তিনি পত্রিকা চালান সেই এলাকার মানুষ তাকে খুব ভালোবাসে। পত্রিকার হকার হলেও শুক্কুর আলী অত্যন্ত নীতিবান। তার বড় ছেলে তাকে এই পেশা ছাড়তে বললেও তিনি ছাড়বেন না বলে জানিয়েছেন। পত্রিকা বিলি করা ছাড়া তার ভালো থাকার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।